, শুক্রবার, ৩ মে ২০২৪

admin admin

মা কী, বোঝার আগেই মেয়েটা মাকে হারাল’

প্রকাশ: ২০২৩-০৩-১৯ ২৩:১৬:১৩ || আপডেট: ২০২৩-০৩-১৯ ২৩:১৬:১৬

Spread the love

‘ওরে আল্লাহরে, এ তুমি কী করলে। আমার তো সব শেষ হয়ে গেল। ওরে আমার সোনার পাখি উড়ে গেল রে। আমার তো আর কেউ রইল না। ‌আমি এখন কী নিয়ে বেঁচে থাকপো।’

রোববার সন্ধ্যায় গোপালগঞ্জ সদরের পাঁচুরিয়া এলাকায় শামসুল হক রোডে সাদিয়া আক্তার সুইটির (২২) বাড়িতে এভাবেই আহাজারি-বিলাপ করছিলেন তাঁর মা বিউটি আক্তার। ওই দিন সকালে পদ্মা সেতুর এক্সপ্রেসওয়ের কুতুবপুর এলাকায় যাত্রীবাহী বাস খাদে পড়ে নিহত ব্যক্তিদের একজন সাদিয়া। সংবাদ দৈনিক প্রথম আলোর।

সাদিয়া ঢাকার মোহাম্মদপুরে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। থাকতেন স্বামীর সঙ্গে ঢাকার মিরপুরে। তবে এর আগে সাদিয়ার বাবা বলেছিলেন, তাঁর মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন।

স্বজনেরা জানান, তিন-চার দিন আগে বাবা-মায়ের কাছে এসেছিলেন সাদিয়া। ছয় মাসের ছোট্ট মেয়ে হুজাইরা বিনতে রেজাকে নানুর কাছে রেখে যাচ্ছিলেন ঢাকায়। সাদিয়াকে এগিয়ে দিতে যাওয়া তাঁর বাবা মোহাম্মদ মাসুদ মিয়াও (৫২) গুরুতর আহত হয়েছেন এই দুর্ঘটনায়।

রোববার সকালে দুর্ঘটনায় ভাইজির মৃত্যুর খবর শুনে গোপালগঞ্জ থেকে মাদারীপুর যান সাদিয়ার চাচা পিল্টন মিয়া। ঢাকা থেকে ছুটে যান তাঁর স্বামী রেজাউর রহমানও। দুপুরের পর মাদারীপুর থেকে সাদিয়ার লাশ আর তাঁর গুরুতর অসুস্থ বাবাকে নিয়ে গোপালগঞ্জে পৌঁছান তাঁরা। সাদিয়ার বাবাকে গোপালগঞ্জ ২৫০ শয্যা হাসপাতালে ভর্তি করে লাশ নিয়ে আসা হয় বাড়িতে। কিছু সময় পরই শুরু হয় প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি।
বৃষ্টি উপেক্ষা করে স্বজন-প্রতিবেশীরা ভিড় করেন পাঁচুরিয়ায় ওই বাড়িতে। এ সময় সেখানে হৃদয়বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয়।

নিহত সাদিয়ার ছোট চাচা পিল্টন মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, সাদিয়ার দুই বোন ছিল। ছোট বোনটা ২০১৭ সালে মারা গেছে। তখন ক্লাস সিক্সে পড়ত। সেই থেকে বাবা-মায়ের একমাত্র সম্বল ছিল এই মেয়েটা। দেড় বছর হলো তাঁর বিয়ে হয়েছে। তাঁর স্বামী ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তাঁদের ছয় মাসের একটি মেয়ে আছে। তাকে নানুর কাছে রেখেই বাবার সঙ্গে ঢাকায় যাচ্ছিলেন সাদিয়া।

নিহতের প্রতিবেশী সাবিহা আলম বলেন, ‘সকালে ভোরে বাড়ি থেকে যাওয়ার সময়ও মেয়েটা আমারে বলে গেছে। গোপালগঞ্জ থেকে সকালে ছয়টায় ওদের বাস ছিল। আমিই খবর শুনে দৌড়ে এসে ওর মারে বলেছি। দুই-দুইটা বোনই চলে গেল। পরিবারটা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। এমন মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না।’

এ সময় ঘরের ভেতরে সাদিয়ার মায়ের কান্না আর আহাজারিতে কেঁদে ফেলেন তিনিও। এর মধ্যেই ‘বাচ্চা ভয় পাবে আর কাঁদবেন না’ বলে তাঁর মাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করতে এগিয়ে যান সাবিহা। তবে কিছুতেই শান্ত করা যাচ্ছিল না তাঁকে।

বিলাপ করতে করতে বলতে থাকেন, ‘আমি কী লেখাপড়া করিলাম রে। কী হইল এই পড়ালেখা কইরে করে। রাস্তায়ই তো মরতে হলো। ওরে তোরা আমারে ছেড়ে দে। আমার মা আমারে ডাকতেছে।‌ মা তুই আমারে নিয়ে গেলি না কেন। আমি এই দুনিয়ায় একা থেকে কী করব?’

গত বুধবার ঢাকা থেকে বাবার বাড়িতে এসেছিলেন তিনি। ছয় মাসের ছোট্ট মেয়ে হুজাইফা বিনতে রেজাকে নানুর কাছে রেখে ঢাকার বাসায় যাচ্ছিলেন।

স্বজনদের আহাজারির ভিড়ে প্রায় স্তব্ধ দাঁড়িয়ে ছিলেন সাদিয়ার স্বামী রেজাউর রহমান। কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙে যাওয়া মেয়েকে কোলে নিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করছিলেন তিনি। তিনি বলেন, ‘ওর ছোট বোনটা মারা গেছে প্রায় পাঁচ বছর। তার নাম ছিল শ্রাবণী আক্তার। আমার মেয়েরও ডাকনাম রাখা হয় শ্রাবণী। এখানে ওর নানুর কাছেই থাকত আমাদের মেয়ে। মাসে দুই-তিনবার আসত সাদিয়া। এই মাসের ২২ তারিখে ওর বয়স ৬ মাস পূর্ণ হবে। আল্লাহ মেয়েটারে বাঁচাইল। কিন্তু মা কী, বোঝার আগেই মেয়েটা মাকে হারাল।’

রোববার রাতে পাঁচুরিয়া মারকাজ মসজিদে জানাজা শেষে পাশের কবরস্থানে দাফন করা হয় সাদিয়াকে। তাঁর আরেক চাচা মোকাররাম হোসেন মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের এই এক্সপ্রেস ওয়ে হয়ে কী লাভ হলো। প্রতিদিনই দুর্ঘটনা হচ্ছে। গাড়ির গতির কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। রাস্তায় বের হতে হয় জীবনটা হাতে নিয়ে। এমন অনিরাপদ জীবন তো কারও কাম্য নয়।’

পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা যায়, আজ সকাল সাড়ে সাতটার দিকে খুলনা থেকে ছেড়ে আসা ইমাদ পরিবহনের একটি বাস পদ্মা সেতুর আগে এক্সপ্রেসওয়ের শিবচরের কুতুবপুর এলাকায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে যায়। এ সময় দুমড়েমুচড়ে যায় বাসটি। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৯ জন মারা গেছেন।

Logo-orginal