, মঙ্গলবার, ৭ মে ২০২৪

admin admin

দুবাই বসে ১০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিল কুমিল্লার মাসুদ।

প্রকাশ: ২০২৩-০৮-২০ ১১:৩৫:২৮ || আপডেট: ২০২৩-০৮-২০ ১১:৩৫:৩১

Spread the love

দুবাইয়ে বসেই কুমিল্লার মাসুদ আল ইসলাম হাতিয়ে নিলেন অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকা বা ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগের নামে বৈদেশিক মুদ্রা বেচাকেনার (ফরেন কারেন্সি এক্সচেঞ্জ বা ফরেক্স ট্রেডিং) ফাঁদ পাতেন তিনি। লোভে পড়ে সেই ফাঁদে পা দিয়েছিলেন অন্তত সাত লাখ মানুষ। সবরকম নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখে ধুলা দিয়ে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রতারণার এই জাল বিস্তার করেন মাসুদ। এমটিএফই নামক একটি মাল্টিলেভেল মার্কেটিং বা এমএলএম ব্যবসার আদলে পঞ্জি স্কিম সাজিয়ে সাধারণ মানুষকে সর্বস্বান্ত করেছেন তিনি। প্রতারণার বিষয়টি জানাজানির পর ইতোমধ্যেই তদন্ত শুরু করেছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) বিভাগের সাইবার অপরাধ তদন্ত ইউনিট।

প্রতিবেদন দৈনিক কালবেলা পত্রিকার।

জানা গেছে, বৈশ্বিক ফরেক্স ট্রেডিং প্রতিষ্ঠান মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ (এমটিএফই) গ্রুপের পরিচয় ব্যবহার করে ভুয়া ‘এমটিএফই’ নামে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন মাসুদ আল ইসলাম। প্রায় সাত বছর ধরে অ্যাপ ও ওয়েবসাইটের মাধ্যমে এর কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। নিজেদের ভুয়া পরিচয় লুকাতে নকল এমটিএফই-এর ওয়েবসাইট এবং অ্যাপ প্ল্যাটফর্ম সাজানো হয়েছে আসল ও বৈধ এমটিএফইর আদলে।

ভুয়া এমটিএফই অ্যাপের একটি স্ক্রিনশট এসেছে কালবেলার কাছে। এতে দেখা যাচ্ছে, বিগত ১০ আগস্ট পর্যন্ত অ্যাপটি তাদের বিনিয়োগকারীদের থেকে ১০৩ কোটি ৪০ লাখ ৭৬ হাজার ৩১২ ডলার ৪২ সেন্ট অর্থ সংগ্রহ করেছে। সাইবার বিশ্লেষকরা বলছেন, এর অন্তত ৯০ শতাংশই বাংলাদেশি বিনিয়োগকারী। সেই হিসাবে অন্তত সাত লাখ বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে এমটিএফই। পরে এই অর্থ দুবাইতে থাকা মাসুদের কাছে পাচার করা হয়েছে। অ্যাপের আরেকটি স্ক্রিনশটে দেখা যায়, ব্যবহারকারীদের অ্যাকাউন্টে ব্যালান্স এখন নেতিবাচক অঙ্কে রয়েছে। এর মাঝেই ব্যবহারকারীদের আরও অর্থ পরিশোধ করে এই নেগেটিভ ব্যালান্স সমন্বয় করার বার্তা দেওয়া হচ্ছে অ্যাপটিতে। অথচ বিনিয়োগকারীদের টাকা উত্তোলন প্রক্রিয়া বন্ধ রাখা হয়েছে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অর্থ পরিশোধ করে ব্যালান্স সমন্বয় করা না হলে ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও বার্তা দেওয়া হচ্ছে অ্যাপে।

আদিলুর রহমান নামে মুন্সীগঞ্জের এক ভুক্তভোগী বলেন, ‘আমাদের বলা হয়েছিল এটি ফরেক্স ট্রেডিং। ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে লেনদেন হয়। কিন্তু আমরা এটি বুঝব না, তাই তারাই সবকিছু অ্যাপে ঠিক করে দিত। আমরা লোকাল এজেন্টদের টাকা দিতাম। সপ্তাহে পাঁচ দিন লাভ দেখাত, আর দুদিন লস; মানে অ্যাপে ব্যালান্সে নেগেটিভ দেখাত। অনেকেই টাকা পেয়েছে দেখে বিনিয়োগ করেছিলাম। কিন্তু মাস খানেক ধরে টাকা আর উঠানো যাচ্ছিল না। সবশেষে বলেছিল, কারিগরি উন্নয়নের জন্য টাকা উত্তোলন বন্ধ আছে, ২২ আগস্ট ঠিক হয়ে যাবে। শুক্রবার অ্যাপে লগইন করে দেখি যে, ব্যালান্স সব নেগেটিভ। স্থানীয় এজেন্টের সঙ্গে একটা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ছিলাম। সেখান থেকে আমিসহ অনেককে বের করে দেওয়া হয়েছে। তখন বুঝলাম যে, এরা পালিয়েছে।’

অনুসন্ধানে জানা যায়, নিজেকে আড়ালে রাখতে বাংলাদেশে শত শত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) বানিয়েছেন মাসুদ। ১০০ জন ব্যবহারকারী অথবা দেড় কোটি টাকা বিনিয়োগ যিনি এনেছেন, তাকেই বানিয়েছেন সিইও। এই সিইওদের মাধ্যমেই দেশের আনাচে কানাচে নেটওয়ার্ক তৈরি করেছেন মাসুদ আল ইসলাম। এমটিএফইর সুনাম প্রচার এবং এলাকার জনসাধারণকে নিয়ে সেমিনার ও মিটিং আয়োজনের জন্য সিইওদের মাসিক ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা করে বেতনও দিতেন মাসুদ। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ভুক্তভোগীরা নিজ নিজ এলাকার এসব সিইওর তালিকা তৈরি করছেন। তাদের মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাসহ অন্তত দুই শতাধিক ব্যক্তি রয়েছেন।

এমটিএফইর ‘অ্যাম্বাসাডর’ পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা পরিচয় গোপন রাখার শর্তে কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা অনেকেই এই মাসুদের ফাঁদে পড়েছি। সবাই এখন আমাদের দোষারোপ করছে, হয়তো আমাদেরও ভুল ছিল, লোভ ছিল; কিন্তু টাকা তো সব মাসুদের কাছে। আমরা তো নিঃস্ব হয়েছিই, সঙ্গে আমাদের মানসম্মান সব শেষ। তবে আমরা এখানে (দুবাই) যারা আছি তারা চেষ্টা করছি মাসুদকে ধরার। এখানে তার পাসপোর্ট এখন পর্যন্ত ব্লক রাখতে পেরেছি আমরা। মাসুদকে পাওয়া গেলে সবার অর্থ ফিরিয়ে আনার আশা রয়েছে।’

এদিকে ঘটনার তদন্তে নেমেছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) বিভাগের সাইবার অপরাধ তদন্ত ইউনিট। শিগগির ইতিবাচক ফলাফলের আশা জাগিয়ে সিটিটিসির অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (এডিসি) নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘বিষয়টি জানার পর এ নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। যারা প্রতারণার মাধ্যমে বা সাইবার অপরাধের মাধ্যমে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছে, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। বেশ কিছু নাম এবং অন্যান্য নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। তদন্তের স্বার্থেই সেগুলো এখন প্রকাশ করছি না। শিগগির একটি ইতিবাচক ফলাফল নিয়ে আসার বিষয়ে আশাবাদী। এর পেছনে যারা জড়িত তাদের গ্রেপ্তার করতে পারলে টাকা ফিরিয়ে আনার একটা সম্ভাবনা রয়েছে।’

অবশ্য প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে অর্থ সংগ্রহ এবং সেই অর্থ পাচারে বিস্ময় প্রকাশ করছেন দেশের আইসিটি খাত সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কন্টাক্ট সেন্টার অ্যান্ড আউটসোর্সিংয়ের সাধারণ সম্পাদক তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘এই অপরাধে ডিজিটাল ব্যবস্থার পাশাপাশি ম্যানুয়াল প্রসেসও জড়িত ছিল। তাদের এজেন্টরা কিন্তু জেলা, উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন ও গ্রামে গিয়ে মানুষদের এখানে বিনিয়োগে উৎসাহিত করত, টাকা সংগ্রহ করত। তাদের একটি সংগঠিত নেটওয়ার্ক ছিল, ‘চেইন অব কমান্ড’ ছিল; কিন্তু কোনো কর্তৃপক্ষের নজরে বিষয়টি আসেনি। এলে তারা নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নিতেন। বিষয়টা আসলে অবাক করার মতো। অথচ এ বিষয়ে তদারকি করা দরকার। ট্রেডিংয়ের নামে কারা টাকা নিচ্ছে, কত টাকা নিচ্ছে, কেন নিচ্ছে—এগুলো মনিটরিংয়ের আওতায় থাকা দরকার।’

সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা বলেন, ‘পুরোপুরি না হলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থার কিছুটা ব্যর্থতা আছে এখানে। বাংলাদেশের পুলিশ এমনিতেই অর্থ বা টাকা-পয়সার বিষয়ে সহজে তদন্ত করতে পারে না। একটা ব্যাংকের তথ্য নিতে হলেও তাকে অনেক আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হয়। আর সাইবার পুলিশ মূলত হ্যাকিং এবং জঙ্গি কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। তবে অর্থ যদি পাচার হয়ে থাকে সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অন্যান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিষয়টা দেখভাল করতে পারত।’

এমটিএফই ওয়েবসাইট এবং অ্যাপের মাধ্যমে পরিচালিত হওয়ায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের ভূমিকা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। এ বিষয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার কালবেলাকে বলেন, ‘পুরোটাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিষয়। এখন পর্যন্ত একজনও আমাদের কাছে এসে কোনো অভিযোগ করেনি। কোনো একটি অভিযোগ এলে এ ধরনের অ্যাপ বন্ধের বিষয়ে যা করা দরকার, সেগুলো করতাম।’

তিনি বলেন, ‘আমার কোনো মনিটরিং সেল নেই, রিপোর্টিং সেল আছে। কেউ যদি মনিটরিং করে আমাকে জানায় যে এই সাইট ক্ষতিকর এবং আমি যদি দেখি যে, আমার দেশের প্রচলিত আইনের বিরোধী, তখন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া আমার দায়িত্ব।’

এমটিএফই এর পর আর কোনো প্রতিষ্ঠান যেন সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করতে না পারে, সেজন্য আগামীতে সতর্কতা ও সচেতনতার ওপর জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ আব্দুল্লাহ আল জাবের বলেন, ‘এ ধরনের বিষয় আগেও বাংলাদেশে হয়েছে। সাধারণ মানুষের লোভকে কাজে লাগিয়ে প্রতারকরা প্রায়ই এমন করছে। তবে কোনো স্ক্যামই এক দিনে হয় না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর রাডারে এটি আসার কথা। এখন যেন অন্তত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ অন্যান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা সতর্ক হয়। বাজারে এমন আরও অনেক প্ল্যাটফর্ম আছে এদের বিরুদ্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।’

Logo-orginal